পাড়ের ধারে রাখা ইতিহাস

22 Nov 2015
0 mins read

এই গল্প সত্য, ঐতিহাসিক- জানি না l কিন্তু কার্যত ইতিহাসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এই গল্প দেশের মধ্যভাগের এক বড় অংশে মানুষের মন ভরিয়ে রেখেছে l

ভালো ভালো কাজ করে যেয়ো- রাজা বলেছিলেন কুড়ন চাষীকে l কুড়ন, বুঢ়ান, সরমন ও কোঁরাই চার ভাই l চার ভাই-ই ভোরে উঠে নিজেদের ক্ষেতে কাজে চলে যেতেন l দুপুর বেলা কুড়নের মেয়ে খাবার নিয়ে যেত পুঁটলি করে l

একদিন খাবার নিয়ে যাবার সময় মেয়েটা একটা দাঁতালো পাথরে হোঁচট খায় l হোঁচট খেয়ে পাথরটার ওপর তার খুব রাগ হলো , তাই দা দিয়ে সে সেটা উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে l কিন্তু একী! দা পাথর স্পর্শ করেতই লোহা থেকে বদলে গেল সোনায়! এরপর খুব দ্রত বদলে যায় এই কাহিনীর ঘটনা – মেয়েটা পাথর তুলে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে পৌঁছায় ক্ষেতে l এক নিঃশ্বাসে বাবা, কাকাদের বলে ফেলে পুরো ঘটনা l চার ভাই-এরও নিঃশ্বাস আটকে আসে l সকলে তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরে l তারা বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের হাতের পাথরটি সাধারণ পাথর নয়, পরশ পাথর l পাথরটি যে জিনসই ছোঁবে তাই সোনা হয়ে তাঁদের চোখ ঝলসিয়ে দেবে l

অবশ্য চোখের এই ঝলকানি বেশীক্ষণ টেঁকে না l কুড়নের মনে হয় বেলা বাড়তেই খবরটা পৌঁছে যাবে রাজার কাছে এবং পাথরটি কেড়ে নেওয়া হবে l তার থেকে ভাল সে নিজেই গিয়ে রাজাকে সবকিছু বলে l

কাহিনী এগিয়ে চলে l এর পর যা কিছু ঘটে তা লোহা নয়, তা হয়ে ওঠে সমাজকে পরশে ছোঁয়ানোর গল্প l

রাজা না পরশ নেন, না সোনা l সব কিছু কুড়নকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেন- যাও, এ-দিয়ে ভালো ভালো কাজ কোরো, পুকুর তৈরী করিয়ে যেয়ো l

এই গল্প সত্য, ঐতিহাসিক- জানি না l কিন্তু কার্যত ইতিহাসকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এই গল্প দেশের মধ্যভাগের এক বড় অংশে মানুষের মন ভরিয়ে রেখেছে l এখানকার পাটন ১ নামক এলাকায় খুব বড় বড় চারটে পুকুর আজও দেখতে পাওয়া যায় এবং যারা গল্পটিকে ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাই করতে চায় তাদের লজ্জা দিয়ে থাকে l চারটি পুকুর এই চার ভাইয়ের নামেই l বুঢ়াগের রয়েছে বুঢ়া সাগর, মাঝগ্রামে সরমন সাগর, কুয়াঁ গ্রামে কোঁরাই সাগর ও কুণ্ডম গ্রামে কুণ্ডম সগর l সময়টা ১৯০৭সাল l কিছু ইংরাজ এই এলাকা পরিদর্শনে আসে l উদ্দেশ্য, গেজেটিয়ারকে ভিত্তি করে ইতিহাস লিখন l তারা এলাকার অনেকের মুখেই এই কাহিনী শোনে এবং পুকুরগুলি ঘুরেও দেখে l তখন সরমন সাগর এত বড় যে তার ধারে তিনটে বড় বড় গ্রামের বসতি l তিনটি গ্রামই পুকুরটিকে নিজের নিজের নামে ভাগ করে নিত এবং এই বিশাল পুকুরটি তিনটি গ্রামকেই যুক্ত করতো ও সরমন সাগরের মতোই স্মরণ করা হতো l সরমন, বুঢ়ান, কোঁরাই ও কুড়নকে – ইতিহাসকে মনে রাখতে হয়নি l পুকুর তৈরী করে এঁরাই ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করলেন l

দেশের মধ্যভাগে বা হৃদয়ে স্পন্দিত এই কাহিনীই পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ চতুর্দিকেই কোন না কোন ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে l আর তারই সঙ্গে পাওয়া যায় শত-শত, হাজার হাজার পুকুর l এই পুকুরগুলির ঠিক হিসেব নেই, আর হিসেব করার ঠিকমতো লোকও নেই l কিন্তু পুকুর তৈরী করার লোক বারে বারে এসেছেন এবং পুকুর তৈরী করে গেছেন l

কোন পুকুর রাজা তৈরী করিয়েছেন তো কোনটা রানী, কোনটা সাধারণ গৃহস্থ, কোনটা বিধবা কোন রমনী, আবার কোনটা হয়তো অসাধারণ কোন সাধু-সন্ত l তবে যিনিই পুকুর করিয়েছেন তাঁকে মহারাজা বা মহাত্মাই বলা হয়েছে l যাঁরা পুকুর তৈরী করেছেন তাঁদের অমরত্ব দিয়েছে কৃতজ্ঞ সমাজ l আর পুকুর তৈরী করে মানুষও সমাজের প্রতি সমান কৃতজ্ঞ l

সমাজ ও তার সদস্যদের মধ্যে এই যুগলবন্দী পথচলা এক দীর্ঘ সময় ধরে চলেছিল l রামায়ণ, মহাভারতের সময়কার পুকুরগুলির কথা যদি আমরা ছেড়েও দিই, তাহলেও বলা যায় পঞ্চম শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত পুকুর তৈরী হয়ে চলেছিলো দেশের এ প্রান্ত থেকে ঐ প্রন্ত পর্যন্ত l প্রায় এক হাজার বছর অবাধ গতিতে চলতে থাকা এই পরম্পরায় পঞ্চদশ শতাব্দীর পর কিছু বাধা আসতে শুরু করে l তবুও পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি, বন্ধ হয়ে যায়নি l এই কাজ সমাজ এত দীর্ঘ সময় ধরে এবং এত ব্যবস্থাসম্মত ও নিয়মিতভাবে করেছিলো যে বিপর্যয়ের সেই সময়ও সে কাজ পুরোপুরি নষ্ট করতে পারে নি l অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত নানা স্খানে পুকুর তৈরী হয়েছে l

এরপর পুকুর তৈরীর লোক ধীরে ধীরে কমে এলো l গোণার জন্য কিছু লোক অবশ্যই আসে তবে কাজের ব্যাপ্তির তুলনায় সে সংখ্যাটা ছিল নেহাতই কম l এবং তাদের দক্ষতাও ছিল তুলনামুলকভাবে কম l তাই সঠিক গণনা কখনও ঠিক হয়ে ওঠেনি l আর একটু একটু করে আংশিকভাবে যেটুকু গোণা হয়েছিল সেগুলি কখনো একত্র করা হয়নি l তবুও এই টুকরো টুকরো হিসাবগুলোই এত ঝলমলে যে এর থেকেই সামগ্রিক উজ্জ্বলতার ধারণা পাওয়া যায় l

জল টলটলে পুকুরগুলিকে শুকনো পরিসংখ্যানে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কোন দিক থেকে করা যায় ? আবার ফেরা যাক দেশের মধ্যভাগে l বর্তমান রিবা জেলায় জড়ৌরি নামক গ্রাম রয়েছে l জনসংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার l কিন্তু গ্রামে পুকুর রয়েছ বারোটা l এরই কাছাকাছি তালমুকোদন l জনসংখ্যা প্রায় পনেরোশো, পুকুর দশটা l সব জিনিসকেই যাঁরা গড়ের হিসেবে দেখতে চান তাদের জন্যও এই ছোট গ্রামগুলিতে প্রতি দেড়শো জনের জন্য একটি ভালো পুকুরের ব্যবস্থা রয়েছে l

জনসংখ্যার এই হিসেব তো এখনকার, যখন পুকুরগুলি তৈরী হয়েছিল তখন জনসংখ্যা ছিল আরো কমl তর্থাত তখন এই বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল যে নিজের এলাকার বর্ষণের প্রতিটি বিন্দু সংগ্রহ করে রেখে তা সংকটের সময় যাতে আশপাশের লোকেদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় l বরুণ দেবতার প্রসাদ গ্রাম অঞ্জলি ভরে নিত l

আর যেখানে প্রসাদ কম পাওয়া যায় ? সেখানে তো তার এক কণা, এক বিন্দুও কি কোনভাবে নষ্ট হতে দেওয়া যেতো! দেশের সব থেক কম বৃষ্টিপাতের এলাকা, যেমন রাজস্থান এবং তার মধ্যেও সব থেকে শুকনো বলে পরিচিত থর মরুভূমিতে অবস্থিত হাজার হাজার গ্রামের নাম পুকুরের নামেই পাওয়া যায় l গ্রামের নামের সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে সর l সর অর্থাত পুকুর l সর নেই তো গ্রাম কোথায় ? ওখানে আপনি পুকুরের বদলে গ্রামই গুণে যান এবং তারপর সেই সংখ্যাটাকে দুই বা তিন দিয়ে গুণ করে দিনl

জনসংখ্যা যেখানে গুণিতকে বেড়েছে ও শহর গড়ে উঠেছে, সেখানেও জল ধার নেওয়া হয়নি কিংবা অন্য কোথা থেকে চুরি করে আনা হতো না l শহরগুলোও গ্রামগুলোর মতো নিজের ব্যবস্থা নিজেই করতো l অন্য শহরের কথা পরে, এক সময়ে দিল্লীতে ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো পুকুরের কথা শুনতে পাওয়া যায় l

গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে রাজ্যে এলাম l আবার ফিরি রিবা গ্রামের কথায় l আজকের মানদণ্ডে একে পিছিয়ে পড়া এলাকা বলতে পারেন l কিন্তু জল ব্যবস্থার হিসেবে যদি দেখা যায় তো বিগত শতাব্দীতে এখানেই সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার পুকুর ছিলো l

দক্ষিণের রাজ্যগুলিকে দেখলে দেখা যাবে স্বাধীনতা পাওয়ার প্রায় একশো বছর আগে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে তিপ্পান্ন হাজার পুকুর গোণা হয়েছিলো l ওখানে ১৮৮৫সালে মাত্র চোদ্দটি জেলায় প্রায় তেতাল্লিশ হাজার পুকুরে কাজ চলছিলো l এই রকমই মহীশূর রাজ্যেও তীব্র উপেক্ষার সমেয়েও ১৮৮০সাল পর্য্যন্ত উলচল্লিশ হাজার পুকুর কোন না কোনভাবে কাজে আসছিল l

এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে থাকা এই পরিসংখ্যান এক জায়গায় করে দেখলে বলা যেতে পারে যে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও আষাঢ়ের প্রথম দিন থেক ভাদ্রের শেষ দিন পর্যন্ত প্রায় এগারো থেকে বারো লাখ পুকুর ভরে উঠতো এবং পরের জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত বরুণ দেবতার ঐ প্রসাদ সবাই মিলে কিছু না কিছু ব্যবহার করতো l কেননা মানুষ তখন ভলো ভালো কাজ করেই যেতো l

১ ) ঝাড়খণ্ড, বিহার, মানভূমে ‘পাটন’ শব্দটির একটি অতি পরিচিত শব্দ l যেকোন চাষীর মুখেই শোনা যায়- কি রে তোর জমিতে পাটন হলো ? পাটন অর্থাত সেচ l শব্দটি দ্রাবিড় ভাষা গোষ্ঠিভুক্ত তামিল শব্দ l

Tags: Aaj Bhi Khare Hain Talab in Bengali, Anupam Mishra in Bengali, Aaj Bhi Khare Hain Talab, Anupam Mishra, Talab in Bundelkhand, Talab in Rajasthan, Tanks in Bundelkhand, Tanks in Rajasthan, Simple living and High Thinking, Honest society, Role Models for Water Conservation and management, Experts in tank making techniques

Posted by
Get the latest news on water, straight to your inbox
Subscribe Now
Continue reading